বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে, যা শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি। অথচ বাস্তবায়ন মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে এখনও প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ প্রকল্পটি ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক এখনও অনুমতি দেয়নি। চিঠি চালাচালিতেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ‘খুলনা থেকে দর্শনা জংশন সেকশনে ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটেছে। এ প্রকল্পটির ওপর গত ১ মার্চ রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটি (পিএসসি) সভা করা হয়। ওই সভায় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর সভাপতিত্ব করেন। সম্প্রতি প্রকল্পটির কার্যবিবরণী পরিকল্পনা কমিশনের পাঠিয়েছে রেল মন্ত্রণালয়।
প্রকল্প পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম ফিরোজী জানান, ‘একনেক সভায় অনুমোদনের পর ২০১৮ সালের ১০ মে প্রকল্পের আওতায় প্রথমবার পরামর্শক নিয়োগে আগ্রহের প্রকাশের জন্য অনুরোধ (ইওআই) টেন্ডার নোটিশ প্রকাশ করা হয়। যা একই বছরের ২৬ জুলাই উন্মুক্ত করা হয়। মূল্যায়নের পর ২টি মাত্র প্রতিষ্ঠান শর্টলিস্টেড হওয়ায় ১৯ আগস্ট এটি বাতিলের সুপারিশ করা হয়। ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের সম্মতিতে ২য় বার ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর ইওআই নোটিশ প্রকাশ করা হয়, যা ১৩ নভেম্বর উন্মুক্ত করা হয়। মূল্যায়নের পর ৩টি প্রতিষ্ঠানকে শর্টলিস্ট করে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংককের সম্মতির জন্য ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পাঠানো হলে তাতে সম্মতি না দিয়ে পুনরায় ইওআই নোটিশ জারির অনুরোধ করা হয়। এরপর ২৫ মে খসড়া ইওআই নোটিশ ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের সম্মতির জন্য পাঠানো হয়। বিভিন্ন দফায় আলোচনা ও পত্র যোগাযোগের পর ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি ইওআই নোটিশের সম্মতি দেওয়া হয়। পরে ৪ ফেব্রুয়ারি পুনরায় ইওআই নোটিশ প্রকাশ করা হয়, যা ৮ মার্চ উন্মুক্ত করা হয়। মূল্যায়নের পর ৫টি প্রতিষ্ঠানকে শর্টলিস্ট করা হয়, যা এক্সিম ব্যাংক ৩১ আগস্ট সম্মতি দেয়।’
পিডি আরও জানান, ‘এক্সিম ব্যাংকের সম্মতির পর ৮ সেপ্টেম্বর শর্টলিস্ট হওয়া পরামর্শকদের আরএফপি ডকুমেন্ট দাখিলের জন্য বলা হয় এবং যা ১০ ডিসেম্বর উন্মুক্ত করা হয়। পিএসসি কর্তৃক মূল্যায়ন করে ২০২১ সালের ৩১ মার্চ এক্সিম ব্যাংকের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হলে ২ জুন কিছু পর্যবেক্ষণসহ তারা ফেরত দেয়। পর্যবেক্ষণ মোতাবেক পুনরায় ২৭ জুন এক্সিম ব্যাংকের অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হলে ৩ জুলাই সম্মতি দেয়। পরবর্তী সময়ে ১৯ জুলাই ফিন্যানসিয়াল অফার উন্মুক্ত করা হয় এবং ১০ নভেম্বর নেগোসিয়েশন সভা অনুষ্ঠিত হয়।’
পিএসসি সভায় রেল সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীরকে পিডি জানান, ‘প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগের বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের সম্মতি গ্রহণে দীর্ঘ সময় লেগেছে এবং চলতি বছরের ৩০ ডিসেম্বর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। এজন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সুবিধার্থে মেয়াদ বাড়ানো প্রয়োজন।
সভায় প্রকল্প পরিচালককে জানানো হয়, ইতোমধ্যেই প্রকল্পের শুরু থেকে প্রায় ৩ বছর ১০ মাস অতিবাহিত হয়েছে। এখনও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের সম্মতি গ্রহণে সময় কম লাগলে প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজতর হবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের মাধ্যমে এই বিষয়টি সুরাহা করার লক্ষ্যে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা প্রয়োজন।
প্রকল্প পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম ফিরোজী জানান, প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ৮ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন মেয়াদ চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে- ‘খুলনা হতে দর্শনা জংশন সেকশনে ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ’ প্রকল্পের মাধ্যমে খুলনা হতে দর্শনা জংশন পর্যন্ত আনুষঙ্গিক কাজসহ ১২৬.২৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ মেইন লাইন নির্মাণ এবং ১৪.৪০ কিলোমিটার ব্রডগেজ লুপলাইন ট্র্যাক নির্মাণ করার কথা রয়েছে। এর বাইরেও ১৬টি স্টেশন বিল্ডিং নির্মাণ, ১৪৭টি ব্রিজ নির্মাণ (গার্ডার ব্রিজ ৪টি এবং বক্স কালভার্ট ১৪৩টি), ৩৭টি প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ (নতুন ২৫টি এবং পুনর্বাসন ১২টি), ২০টি প্ল্যাটফর্ম শেড নির্মাণ (নতুন ১৭টি এবং পুনর্বাসন ৩টি), ১৭টি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ, ১৮টি কম্পিউটার বেইজড সিগন্যালিং সিস্টেম স্থাপন এবং ১১০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে।
পিএসসি সভার সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে- নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব নয় বিধায় প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধি করতে হবে। দ্রুত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের বিষয় চূড়ান্ত করার জন্য প্রকল্প পরিচালককে সচেষ্ট থাকতে হবে।
প্রকল্প পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম ফিরোজী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এই প্রকল্পটি এলওসি ঋণের প্রকল্প। এলওসির প্রকল্পে এমনিতে প্রসিডিউরলি সময় বেশি লাগে। এই প্রকল্পের দুটি পার্ট। প্রথম পার্টে ছিল ফিজিবিলিটি স্টাডি, ডিটেইল ডিজাইন এবং টেন্ডারিং সার্ভিস। দ্বিতীয় পার্টে হলো বাস্তবায়ন।’
তিনি বলেন, ‘প্রথম পার্টে আমাদের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করার কথা। যেটাতে আমাদের তিনবার ইওআই কল করতে হয়েছে। এই তিনবার ইওআই কল করারও অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমবার পর্যাপ্ত বিডার পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়বার একই সমস্যাতে পড়তে হয়েছে। আর তৃতীয়বার এলওসির শর্ত নিয়ে ভারতের কথা বলতে প্রায় এক বছর সময় চলে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে প্রকল্পটি একটু দেরি হয়ে গেছে।’
প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, ‘আশার কথা হলো এখন সবকিছু এড্রেস করে পরামর্শক নিয়োগের জন্য পারচেজ প্রপোজাল সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কমিটিতে আছে। আমরা আশা করছি, এ সপ্তাহে পারচেজে অনুমোদন না হলেও পরের সপ্তাহে অনুমোদন হবে। ক্রয় কমিটিতে অনুমোদন পেলেই আমরা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করতে পারবো।’
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক পরামর্শক নিয়োগে কেন অনুমতি দিচ্ছে না, এর কারণ বের করতে হবে। বৈদেশিক ঋণের আওতায় আমরা ভারত থেকে খুবই অল্প মাত্রার ঋণ পাই। এই চিহ্নিত প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ায় সাধারণ জনগণ এর উপকার পাবে না।’
এরকম ঋণ বাংলাদেশকে নেওয়া উচিত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই ঋণের পরিমাণ খুবই সামান্য। সময় মতো ঋণের টাকা না পেলে ঋণ বাদ দিয়ে নিজেদের অর্থায়ন বা অন্য কোন সোর্স থেকে টাকা এনে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। যেকোন ঋণের ক্ষেত্রে অর্থ ছাড়ের আশঙ্কা তৈরি হলে অন্যান্য দেশের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমার মতে এই তিন বছর সময় নষ্ট করার কোনো দরকার নেই। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে ঋণের টাকা পেলে নেবে, নতুবা অন্য উপায় খুঁজবে। তাহলে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।
Leave a Reply