চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের গুদাম থেকে ছয় লাখ পরীক্ষার খাতা এবং চার লাখ অতিরিক্ত খাতা বা লুজশিট উধাও হয়ে গেছে। গত এক সপ্তাহ আগে ঘটনাটি ধরা পড়লেও গোঁজামিল দিয়ে সংকট সমাধানের চেষ্টা চলছে, যা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে বোর্ডে। এরপর থেকে সামনে এসেছে একের পর এক ফল জালিয়াতির ঘটনা। খাতা লুট আর ফল জালিয়াতি একই চক্রের কাজ বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষা বোর্ডের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, ঠিকাদার এবং বাইরের একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে বোর্ডকেন্দ্রিক নানা দুর্নীতিতে লিপ্ত। আগে এই চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করতেন পলাতক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। জুলাই বিপ্লবের পর শীর্ষ পদগুলোতে পরিবর্তন এলেও নিচের দিকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রয়েছেন অপরিবর্তিত। ফলে চক্রটি এখনো সক্রিয়।
শিক্ষা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বোর্ডের গুদামে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য বিশেষায়িত খাতা থাকার কথা ছিল ১৬ লাখ ৪৫ হাজার ১৮৯টি। কিন্তু গণনার পর ১০ লাখ ৪৭ হাজার খাতা পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, উধাও হয়ে গেছে প্রায় ছয় লাখ খাতা। একইসঙ্গে ১২ লাখ ৪৮ হাজার ৭৯০টি অতিরিক্ত খাতা বা লুজশিটের স্থলে সাড়ে আট লাখ খাতা পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রেও প্রায় চার লাখ লুজশিট গায়েব হয়ে গেছে। গায়েব হয়ে যাওয়া খাতার কারণে ঝুঁকিতে পড়েছে পুরো শিক্ষা বোর্ড। আগামী যে কোনো মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষায় এসব খাতা অপব্যবহার হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
শিক্ষা বোর্ড সূত্র জানায়, এই শিক্ষা বোর্ডে ফল জালিয়াতচক্র সক্রিয় থাকার বিষয়টি প্রথমে সামনে আসে ২০২৩ সালের শেষদিকে। ওই বছর ফল জালিয়াতির মাধ্যমে নিজের ছেলে নক্ষত্র দেব নাথকে জিপিএ-৫ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে বোর্ডের তৎকালীন সচিব ও সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় কারাগারে যেতে হয় নারায়ণ চন্দ্রকে। সেই থেকে এ বোর্ডের ফল জালিয়াতির ঘটনা আলোচিত হয় বারবার। এ বছরও অন্তত ২৩ শিক্ষার্থীর রেজাল্টে ৩৫টি বিষয়ের খাতায় পাওয়া নম্বরের সঙ্গে সার্ভারে প্রকাশ হওয়া ফলের স্পষ্ট ব্যবধান ধরা পড়ে। খাতায় পাওয়া নম্বর থেকে রেজাল্টশিটে আট থেকে ২০ নম্বর করে বেশি দেখানোর অভিযোগের সত্যতা মিলেছে বোর্ডের অভ্যন্তরীণ তদন্তে। জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়লে ওই ২৩ শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন করে খাতায় পাওয়া নম্বর ফের সার্ভারে আপলোড করে বোর্ড কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি জানাজানি হলে প্রফেসর মুহাম্মদ একরামুল হককে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বোর্ড।
রেজিস্ট্রেশন জালিয়াতির অভিযোগ
ফল জালিয়াতির পাশাপাশি ভয়াবহ রেজিস্ট্রেশন জালিয়াতির ঘটনাও ঘটেছে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে। এক ছাত্রীর রেজাল্টশিটকে আরেক ছাত্রের রেজাল্ট হিসেবে দেখানো হয়েছে।
বোর্ড সূত্র জানায়, খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার হাফছড়ি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০২৫ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় সাদিয়া জাহান লাভলী নামের এক ছাত্রী। একই বছর খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার শহীদ লে. মুশফিক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষায় অংশ নেয় পিয়াল আশরাফ শান্ত নামের আরেক ছাত্র। পরীক্ষায় সাদিয়া জিপিএ-৩.৭৮ অর্জন করে। আর পিয়াল জিপিএ-৩.৪৪ অর্জন করে। কিন্তু বোর্ড কর্মকর্তারা সাদিয়ার রেজাল্ট পিয়ালের বলে চালিয়ে দেন। সাদিয়ার মার্কশিটে নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম পরিবর্তনের লিখিত নির্দেশনা দেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. পারভেজ সাজ্জাদ চৌধুরী। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন নম্বর অপরিবর্তিত থাকায় ধরা পড়ে বড় এই জালিয়াতির ঘটনা।
বিষয়টি জানাজানি হলে তদন্ত কমিটি গঠন করে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড। সাম্প্রতি তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। বোর্ড সূত্র জানায়, চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার দায় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এড়াতে পারেন না। কিন্তু তদন্ত কমিটি এ ঘটনাকে নিছক ভুল হিসেবে চিহ্নিত করে দায়সারা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের পলাতক শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের অনুসারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই এখনো নিয়ন্ত্রণ করছেন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড। এই সিন্ডিকেটই বহু বছর ধরে ফল জালিয়াতি করে আসছে। প্রতিটি রেজাল্টের জন্য ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা করে লেনদেন হচ্ছে। টাকা দিলে ফেল করা শিক্ষার্থীদেরও জিপিএ-৫ পাইয়ে দিচ্ছে সিন্ডিকেটটি।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সচিব প্রফেসর ড. সামছু উদ্দিন আজাদ জানান, গত ১৬ বছর ধরে বোর্ডের স্টোর মেলানো হয়নি। সাম্প্রতি তিনি স্টোরের তথ্য হালনাগাদ করতে শুরু করেছেন। এতে খাতাসহ আরো বেশকিছু জিনিস রেজিস্টারের সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে না। স্টোর মেলানোর কাজটি চলমান। শেষ হলে বিস্তারিত জানানো যাবে।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পারভেজ সাজ্জাদ চৌধুরী জানান, বোর্ডের কম্পিউটার শাখায় জনবল কম থাকায় দু-তিনজন অপারেটরকে দিয়ে অনেক কাজ করাতে হয়। আর এ কারণেই ভুলে বেশকিছু খাতায় নম্বর বেশি পোস্টিং হয়েছে। বিষয়টি জানার পরপরই সার্ভারে সংশোধন করা হয়েছে, যা নিয়ে তদন্ত চলছে। যদি কারো গাফিলতি পাওয়া যায়, তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ইলিয়াস উদ্দিন আহাম্মদ জানান, খাতা উধাও হওয়ার বিষয়টি তিনি শুনেছেন। স্টোরে আরো কোনো জিনিস কম আছে কি-না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিষয়গুলো নিশ্চিত হওয়ার পর আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রাথমিকভাবে খাতা কম থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ায় এ বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন। ফল জালিয়াতির ঘটনায় তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তাদের দেওয়া প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আর রেজিস্ট্রেশন জালিয়াতির ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কিন্তু এতে পূর্ণাঙ্গ তথ্য উঠে এসেছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তাই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আরেকটি তদন্ত কমিটি করার কথা ভাবা হচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রাম জেলা শাখার সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী জানান, কোনো শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন করে দেওয়ার মতো গর্হিত অপরাধ আর হয় না। শুধু ফল পরিবর্তনই নয়, এবার নারীকে পুরুষ বানিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। ধরা পড়ার পর কম্পিউটার অপারেটরদের মতো সাধারণ কর্মচারীদের ওপর দায় চাপানোর অপচেষ্টা চলছে। এখানে সার্ভারের পাসওয়ার্ডসহ নিরাপত্তাজনিত অনেকগুলো গেটওয়ে থাকার কথা। সেগুলো একটি সাধারণ কর্মচারীর পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ছয় লাখ খাতা গায়েব হওয়ার বিষয়টিও অস্বাভাবিক। বোর্ডে প্রতি বছর অডিট হওয়ার কথা। নিজেদের জবাবদিহির জন্য হলেও স্টোরের তথ্য হালনাগাদ থাকতে হবে। এখানে একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ নেই।
সংগৃহীত সংবাদ
Leave a Reply